মিছিলটা শুরম্ন হলো টিএসসি থেকে। গনত্দব্য কার্জন হল হয়ে মেডিকেল এর সামনে দিয়ে ফুলার রোড হয়ে নবনির্মিত শহীদ মিনার। তপু আর দীপা মিছিলের মাঝ বরাবর। তপুর হাতে বিশাল এক পস্নাকার্ড। তাতে লেখা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। দীপার হাতেও শোভা পাচ্ছে অ, আ, ক, খ লেখা পস্নাকার্ড। মুখে শেস্নাগান, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সবার মনেই দৃঢ় প্রত্যয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। তবে ব্যতিক্রম একজন আর সে হলো তূর্য্য। দীপার জন্যই মূলত ওর মিছিলে যোগদান। তূর্য্য দীপাকে ভালবাসে। তাই দীপাকে চোখে চোখে রাখার জন্যই ওকে ছায়ার মতো অনুসরন করে ও। কিন্তু মেয়েটা ওকে মোটেও পাত্তা দেয়না। সারাৰন ঝাড়ির উপরে রাখে। সহপাঠী হিসাবে যতটুকু সম্পর্ক থাকার কথা ততটুকুই রাখতে চায় দীপা। কিন্তু তূর্য্য এতে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তূর্য্যর সেই এক কথা। আমাকে ভালবাসতে তোমার বাধা কোথায়? আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন মানুষ। দেখ আমার রক্তও তোমার মতো লাল। আমি পাকিসত্দানী বলে আমাকে ঘৃনা করনা। দেখ আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি দীপা। কিন্তু দীপা ওকে সাফ সাফ বলে দিয়েছে ওকে কিছুতেই ভালবাসতে পারবে না। ও যেন ভবিষ্যতে কোন সিনক্রিয়েট না করে। কিন্তু ছেলেটা যে কিনা। পাগল একটা কোথাকার। আড়চোখে তাকায় দীপা। নিশ্চিত হয় অবশেষে। আছে। পাগলটা আছে। তপু আর দীপার দুই হাত পিছনেই ঠোট মিলাচ্ছে তূর্য্য। আর আড়চোখে দীপার দিকে নজর রাখছে।
তূর্য্যর বাবা পাকিসত্দান সরকারের একজন বড় আমলা। ওদের ফ্যামিলিও পাকিসত্দানি বংশোদ্ধুত। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য তো কোন পাকিসত্দানীর প্রানপাত করার কথা নয়। কিন্তু তূর্য্য কেন এইসব মিছিলে? ওকি জানেনা এটা অনেক রিস্কি। যে কোন সময় পুলিশের লাঠিচার্জ হতে পারে। গোলাগুলিও বিচিত্র কিছু নয়। কারন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। পাকিসত্দান সরকার উদর্ুকে রাষ্টভাষা করার ঘোষনা দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী পাকিসত্দানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার ঘোষনা দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ তমুদ্দিন মজলিস গঠন করেছে। সারা দেশব্যাপী হরতাল, মিছিল, সমাবেশ হয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সর্বসম্মত সিদ্ধানত্দ গ্রহন করা হয়েছে। সারা দেশব্যাপী গন-আন্দোলন থামানোর জন্য সৈরশাসক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারী ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে।
সকাল বেলা বাসা থেকে বেরম্নতেই বাবার সামনে পড়ে গেল দীপা।
কিরে মা কোথায় যাচ্ছি?
কই আবার? ভার্সিটিতে যাচ্ছি বাবা।
আজ কি না গেলে হয় না মা?
তা কি করে হবে বাবা।
আজ তো যেতেই হবে।
নারে আজ আর যাসনে। বাইরের পরিস্থিতি মোটেও ভালো না। রেডিওর খবরে বললো আজ নাকি ঢাকায় ১৪৪ ধারা করেছে ।
১৪৪ ধারা করছে তো কি হয়েছে? এত ভয় পেলে চলে বাবা? দীপার যুক্তি।
তারপরও তুই মেয়েমানুষ। এত গন্ডগোলের ভিতরে বাইরে যাবি?
বাবা! তুমি শুধু শুধু টেনশন কর। আমার মতো কত মেয়েই তো যাচ্ছে। দেখ বাবা বিষয়টা খুবই সেনসিটিভ। আমাদের আত্নার সাথে জড়িয়ে আছে। এটা কি করে সম্ভব বাবা? ওরা! ওরা! আমাদের নিঃশ্বাস কেড়ে নিতে চায়। আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তবুও তুমি বলছ আমাকে চুপ করে থাকতে। না বাবা এটা হয়না।
আমি জানি রে মা। কিন্তু আমি যে পিতা, আমি তোকে এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছেড়ে দিতে পারিনা।
ওহ! বাবা তুমি কিচ্ছু ভেবনা। আমার সাথে তপু থাকবে।
তপু কোনটা রে। প্রশ্ন আনিস সাহেবের।
কেন চিনতে পারছ না? তোমার সাথে না পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওই যে মাথায় ঝাকড়া চুল, খোচা খোচা দাড়ি, খদ্দরের পাঞ্জাবী পড়ে, আর সবসময় কাধে একটা চটের ব্যাগ ঝোলানো থাকে। আর কবিতা টবিতা লেখে।
ও হ্যা হ্যা ! এবার চিনতে পারছি। ওই লাজুক ছেলেটা। বেশ ভদ্র একটা ছেলে। মনে মনে আশ্বসত্দ হন আনিস সাহেব।
আচ্ছা ঠিক আছে যা, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস মা।
মিছিলটা ধীর গতিতে এগুচ্ছে ফুলার রোড হয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দিয়ে। রাসত্দার দুপাশেই সশস্র দাঙ্গা পুলিশ দাড়িয়ে আছে। শেস্নাগানে শেস্নাগানে মুখরিত রাজপথ। ছাত্র-শিৰক, বুদ্ধিজীবী, যুবা কিশোর থেকে শুরম্ন করে বৃদ্ধ পর্যনত্দ নারী পুরম্নষ নির্বিশেষে সবার একটাই দাবী রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে খন্ড খন্ড মিছিলগুলো শেষ পর্যনত্দ এক বিশাল জন সমুদ্রে পরিনত হল। এত দীর্ঘ মিছিল দেখে শাসক গোষ্ঠী হকচকিয়ে গেল। তাদের শাসনের ভিত নড়ে উঠল। তারা ভীত সন্ত্রসত্দ হয়ে বাঙ্গালীর প্রানের দাবীকে সমূলে বিনাশ করার জন্য দমন নিপীড়নের পথ বেছে নিল। শাসকগোষ্ঠী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল, যে ভাবেই হোক গনজাগরন ঠেকাতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের বন্যা বইবে। লাশের স্তুপ হবে। তবু মিছিল ছত্রভঙ্গ হবে। এমন নির্দেশে ঠিক দুপুর ২:১৫ মিনিটে শুরম্ন হল গোলাগুলি। তিরিশ মিনিটের ব্যবধানে রক্তের বন্যা বয়ে গেল। একের পর এক লাশ পড়তে লাগল। হঠাৎ অতর্কিত আক্রমনে একে একে ঢলে পড়লেন রফিক, শফিক, জব্বার, শফিউর সহ আরো নাম না জানা অনেক তাজা প্রান। আহতদের আর্তচিৎকারে কেপে উঠল পুরো দুনিয়া।
দীপার চোখের সামনেই একের পর এক লাশ হতে লাগল তারই সহপাঠী বন্ধুরা। দীপা কি করবে ভেবে পেল না। কেমন হতবিহবল হয়ে গেল। একটু সম্বিত ফিরতেই তপুকে খুজল দীপা। না। নেই তপু তো নেই। তপু তো দীপার হাত ধরেই ছিল। তপু গুলি খায়নি তো? তপুর অমঙ্গল আশঙ্কায় হৃদপিন্ড কেপে উঠল দীপার। ইতোমধ্যে পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। লাশগুলো সব তোলা হচ্ছে গাড়িতে। লাশের স্তুপের ভিতরে ৰিন কন্ঠের 'দীপা' ডাক শুনতে পেল। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ওর। ওহ তাহলে তপু ওখানে? দৌড়ে কাছে গেল দীপা। রক্তাক্ত তূর্য্যকে দেখে হতভম্ব হল ও। পাজরে গুলি লেগেছে তূর্য্যর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। দীপা কি করবে ভেবে পেলনা। তূর্য্য এভাবে ভালোবাসার প্রমান দিয়ে গেল। দীপার জন্যই তূর্য্যের আজ এ পরিনতি। তূর্য্য তো শুধু দীপার ভালবাসার জন্যই উম্নুখ ছিল। হায় দীপা একি দেখল শেষ পর্যনত্দ ।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তূর্য্য। ৰীন অস্ফুট কন্ঠে বলল তূর্য্য, দীপা আমাকে ৰমা কর। আমি আর তোমার পিছু নেব না। তোমার পথের কাটা হয়ে দাড়াব না। আমাকে একটু ধর বলে হাত বাড়িয়ে দেয় তূর্য্য। রক্তাক্ত হাতটা ধরে দীপা। পুলিশের দুজন কনস্টেবল তূর্য্যকে তুলতে এল। আর একটা কথা, দীপা আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। পিস্নজ আমাকে বিশ্বাস কর। দেখ আমার রক্তও লাল। এই রক্তের কসম। আমি তোমাকে ভালোবাসি। দেখ মরার সময় কেউ মিথ্যা বলে না। আমাকে একটু ভালোবাসতে পারলে না দীপা? আমার কি অপরাধ ছিল? জড়ানো আহত কন্ঠ তূর্য্যর।
তূর্য্যকে নিয়ে গাড়িটা ঢাকা মেডিকেলের দিকে চলে গেল। তোমার কি অপরাধ তা আমি জানিনা তূর্য্য। হয়তো তুমি আমাকে একটু বেশীই ভালোবেসেছিলে। অস্ফুট কন্ঠে বলল দীপা।
প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় পৌছল তপু। যাক বড় বাঁচা গেল। এ যাত্রা কোনমতে রৰা। জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারার আনন্দে আত্নহারা ও। এতৰন দীপার কথা মনেও ছিল না ওর। রেডিও সেটের সামনে বসল তপু। রেডিওতে বিশেষ বুলেটিন হিসাবে মিছিলে গোলাগুলির খবর প্রচারিত হল। সবমিলিয়ে ৬ জন নিহত আর প্রায় ৫০ জনের মতো আহত হল। নিহতের মধ্যে একজন মেয়ে। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল তপুর। নিহত মেয়েটা কে? দীপা নয়তো। দীপার অমঙ্গল আশঙ্কায় অনত্দরাত্না কেপে উঠল ওর। দীপা কেমন আছে, দীপা সুস্থ্য আছে তো? এ চিনত্দাটা মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু। কিনত্দু বাইরের অবস্থা তো উত্তপ্ত। মিছিলে গোলাগুলির পর রাসত্দায় বেরম্ননো তো খুবই রিস্কি হয়ে যাবে ভেবে বাইরে বেরম্ননো থেকে নিজেকে নিরসত্দ করল তপু। কাল না হয় একবার দীপার বাসায় গিয়ে ওর খোজ করে আসবে ভেবে নিজেকে স্বানত্দনা দিল ও। রেডিও তে সন্ধ্যার বুলেটিনে নিহত ৬ জনের নাম, ঠিকানা প্রকাশ হল। যাক হাফ ছেড়ে বাঁচল তপু। দীপা তাহলে ওদের মধ্যে নেই। দীপা তাহলে সুস্থ্যই আছে। যদি আহত হয়ে গিয়ে থাকে? নিজেকে খুব ছোট মনে হল তপুর। হায় সেতো একটা কাপুরম্নষ। তপু তো দীপার হাত ধরেই ছিল। লাঠিচার্জ হতে না হতেই তপু আর দীপাকে খুজেই পেলনা। আর দীপাই বা কোথায় গেল? তপু একটা ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করল। দীপা নিশ্চয়ই নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়েছে। তপু তো দীপাকে খুজেছে। আর খুজে না পেলে ও কি করতে পারে। তারপরও বিষয়টা কেমন খটকা হয়েই থাকল। অপরাধবোধে ভুগতে লাগল তপু।
ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলেও তূর্য্যকে বাঁচানো যায়নি। দীপার চোখের সামনেই তূর্য্য মারা গেল। দীপার হাতটা তখনও ধরে ছিল তূর্য্য। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন নিসত্দব্ধ হয়ে গেল। তূর্য্য চলে গেল। চোখ ফেটে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল দীপার। হায়রে ভালোবাসা। এভাবেই যুগে যুগে ভালবাসার জন্য কত প্রেমিক নিজেকে উৎসর্গ করে। তূর্য্যও অবশেষে তাই করল। অপরাধবোধে ভুগতে লাগল দীপা। দীপার জন্যই তো তূর্য্যের আজ এমন পরিনতি। এর জন্য দীপাই দায়ী। ভালোবাসার জন্য তূর্য্য জীবন দিয়েছে। কিন্তু দীপা এমন ভালবাসার কি প্রতিদান দিতে পারে? দীপা কি এতটাই স্বার্থপর হবে। দীপার অবচেতন মন বলে উঠল। নাহ! দীপা এতটা স্বার্থপর হতে পারবে না। তূর্য্যর ভালোবাসার প্রতিদান হিসাবে দীপা সারজীবন একা থাকারই সিদ্ধানত্দ নিল অবশেষে। কারন ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গের তুলনায় এটা খুব বেশী কিছু নয়। আর তপুর ভালোবাসার স্বরম্নপও তার এখন অজানা নয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম
যেখানে সমষ্টিগতভাবে পাকিস্থানীদেরকে আমরা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছি এবং সারাটা জীবন দেখবো । সেখানে তূর্য্য তার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছে একজন পাকিস্থানী হয়েও ! এক অন্যোন্য কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন লেখক ! আরো ভাল গল্প পড়ার প্রত্যশায় শুভকামনা ।
রোদের ছায়া
প্রেম চিরকালীন .......হোক তা বায়ান্ন,একাত্তর বা দুহাজার সাল সব সময় প্রেম ছিল মানুষের মাঝে .....গল্পটি বেশ লাগলো ... ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটাও সুন্দর করে বলার জন্য ধন্যবাদ /
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।